Wednesday, April 22, 2020

কালাম শাস্ত্র এবং ইসলাম

কালাম শাস্ত্র বলতে দর্শনভিত্তিক ধর্মতত্ত্বকে বোঝায়, অর্থাৎ দর্শনকেন্দ্রিক আকিদা বা সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্রান্ত বিশ্বাস। শাব্দিক অর্থে কালাম অর্থ বক্তৃতা, কথা,যুক্তি প্রভৃতিকে বোঝায়। বলা হয় প্লেটোনিক লোগোস থেকে কালাম শব্দটি এসেছে। দর্শনগুলো সাধারনত কোন মানুষের বুদ্ধি-বিচার ও যুক্তির নির্ভর করে মনগড়া কথা বা বক্তব্য। আরবিতে আলাদাভাবে গ্রীক দর্শনকে সরাসরি  ফালসাফাও বলা হয়।

এই ফালসাফা বা ফিলসফি যখন আরবে পৌছায় সেসবকে ইসলামের সাথে মেশানো হয়।  সেসব দ্বারা ইসলামের যাবতীয় আকিদাগত বিষয়কে ব্যাখ্যা করা হয়। কেউ কেউ ইসলামকে যৌক্তিক ধর্ম বানাতেও গ্রীক দর্শনের সাহায্য নিতে শুরু করে। এ সকল দর্শন আজকের বিজ্ঞানের প্রাচীন রূপ এবং আসল পরিচয় হচ্ছে অকাল্ট বা যাদু। গ্রীক ফিলসফির অরিজিন হলো ব্যাবিলনীয়ান মিস্টিসিজম সোজা কথায় শয়তানের আবৃত্ত শাস্ত্র। তো, গ্রীক দর্শনকে ইসলামাইজ করে সম্মান দিয়ে ডাকা শুরু হয় ইল্মুল কালাম বা কালাম শাস্ত্র। কালামিরা দর্শনকে গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য ভাল শব্দগুলোকে ব্যবহার করতো। যেমনঃ দর্শনকে ডাকা হত 'হিকমাহ','ইল্মে তাওহীদ' ইত্যাদি। ইবনে সিনা তার কিতাবগুলোর নামের শুরুতে হিকমাহ শব্দটি যোগ করতেন। এরা সবধরনের অকাল্ট ফিলসফির অনুসারী এবং চর্চাকারী। যাইহোক,হার্মেটিক/কাব্বালিস্টিক যাদুবিদ্যা[i.e: Alchemy] কালামশাস্ত্রেরই অন্তর্ভুক্ত বিষয়। প্রাচীন নামধারী মুসলিমগুলো যখন কালাম শাস্ত্র বা দর্শনকে গ্রহন করলো,  মু'তাযিলা, জাহমিয়্যাহসহ অনেক ফির্কার জন্ম হলো। হুলুল ইত্তেহাদ, ওয়াহদাতুল উজুদসহ সমস্ত কুফরি আকিদাগুলো ইসলামে প্রবিষ্টকরনে কালামীগন সক্রিয় ছিল। কালামি(মুতাকাল্লিমীন) বলতে গ্রীক দর্শনে বিশ্বাসী; ইসলামে কাফিরদের আকিদাগুলোর(প্যাগান ফিলসফি) সমন্বয় কারকদের বুঝায়। কালামিরা সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যায় গ্রীক দর্শন ব্যবহার করত,এগুলো ব্যবহার করে কুরআন হাদিস এর বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান করত, দর্শনের বিশ্বাসগুলোকে ইসলামের সাথে সমন্বয় করত।মানব অস্তিত্ব রূহের প্রকৃতি এসবের আকিদায় প্লেটোর বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিত। যা ইসলাম বলত না সেসবও গ্রীক দর্শন থেকে গ্রহন কর‍ত। গ্রীক দর্শন থেকে গ্রহনকরা সেরা উপহার ছিল 'ওয়াহদাতুল উজুদ, হুলুল ইত্তেহাদের ' আকিদাহ। কালামিরা দর্শনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ইসলামের অখণ্ডনীয় বিষয় গুলোকেও অস্বীকার করা শুরু করে। আজকের অপবিজ্ঞানপন্থী মুসলিমরা যেভাবে অপবিজ্ঞান ও ইসলামের সমন্বয় করে মধ্যযুগীয় কালামীরাও দর্শনের বেলায় তাই করে। মূলত উভয় বিদ্যার গোড়া অভিন্ন। তেমনি আজকের অপবিজ্ঞানপন্থী মুসলিমরাও কালামিদের উত্তরসূরী যদিও তারা মুখে না স্বীকার করে।


আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের দাবিকারীরাও কালামশাস্ত্র তথা গ্রেসিয়ান-ব্যবিলনীয়ান অকাল্ট ফিলসফি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তৈরি হলো আশআরি ও মাতুরিদি চিন্তাধারা। আল্লাহর সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালার করুনা ছিল কিছু আলিমদের উপর যারা সালাফ আস সালেহীনদের আকিদাকে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন। তারা নিজেদেরকে বাতিল আকিদা থেকে আলাদা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন, এদেরকে বলা হয় আসারি। আসারি স্কুল অব থট গায়েবি বিষয় 'শুনলাম এবং মানলাম' নীতি অনুসরন করে। সাহাবিয়্যাতের আকিদা সরাসরি ধারন করে। কোন ধরনের আকল খাটিয়ে বা দর্শনকে ব্যবহার করে সেসবকে ব্যাখ্যার দিকে যায় না। যাইহোক, সেসব আসারি আলিমদের ফিতনা মোকাবিলায় ভূমিকা ছিল অসামান্য। কালামশাস্ত্র তথা গ্রীক দর্শনের ইসলামিক রূপটাই যে কেবল একক এমনটা ভুল। ইহুদিদের মধ্যেও কালামি ছিল[10], তাদের গুরু মোজেস বেন মাইমন। মাইমনন্ডিসকে কাব্বালিস্টরা গুরুভক্তি করে। যাইহোক, কালামশাস্ত্র বা দর্শনের আসল উৎস হচ্ছে যাদুশাস্ত্র। কালামশাস্ত্রের একটা বড় কন্সেপ্ট হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, কস্মোলজিক্যাল আইডিয়া[11]। এসব কিছুতেই গ্রীক অকাল্ট দর্শনকে গ্রহন করা হয়। এসবকে যুক্তি দিয়ে দ্বীনের সাথে সমন্বয় করা।ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সহচরগণ ‘ইলমুল কালামৎ শিক্ষা করতে ঘোর আপত্তি করেছেন। ইলমুল কালামের প্রসার ঘটে মূলত দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমাংশে, বিশেষত ১৩২ হিজরী (৭৫০ খৃ) সালে আববাসী খিলাফতের প্রতিষ্ঠার পর। ইমাম আবূ হানীফা শিক্ষা জীবনে বা তাঁর জীবনের প্রথম ৩০ বৎসরে (৮০-১১০ হি) দর্শনভিত্তিক ইলমুল কালাম সমাজে তেমন পরিচয় লাভ করে নি। তবে দর্শনভিত্তিক বিভ্রান্ত মতবাদগুলো তখন কুফা, বসরা ইত্যাদি এলাকায় প্রচার হতে শুরু করেছে। গ্রীক-পারসিক দর্শন নির্ভর কাদারিয়া, জাবারিয়া, জাহমিয়া ইত্যাদি মতবাদ দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরু থেকেই জন্ম লাভ করে। এ সকল মতবাদ খন্ডন করতে মূলধারার কোনো কোনো আলিম দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা নির্ভর যুক্তি-তর্কের আশ্রয় নিতে থাকেন।

কোনো কোনো জীবনীকার উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) প্রথম জীবনে এরূপ দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা নির্ভর বিতর্ক বা ইলমুল কালামের চর্চা করেন। পরবর্তীতে তিনি তা বর্জন করেন এবং তা বর্জন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। ইলমুল কালামের প্রাথমিক অবস্থাতেই তিনি এর ক্ষতি ও ভয়াবহতা অনুধাবন করতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

كنت أعطيت جدلا فى الكلام ... فلما مضى مدة عمري تفكرت وقلت السلف كانوا أعلم بالحقائق ولم ينتصبوا مجادلين بل أمسكوا عنه وخاضوا فى علم الشرائع ورغبوا فيه وتعلموا وعلموا وتناظروا عليه فتركت الكلام واشتغلت بالفقه ورأيت المشتغلين بالكلام ليس سيماهم سيماء الصالحين قاسية قلوبهم غليظة أفئدتهم لا يبالون بمخالفة الكتاب والسنة ولو كان خيرا لاشتغل به السلف الصالحون

‘‘কালাম বা দর্শনভিত্তিক বিতর্কে আমার পারদর্শিতা ছিল ... আমার জীবনের কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমি চিন্তা করলাম যে, পূর্ববর্তীগণ (সাহাবীগণ ও প্রথম যুগের তাবিয়ীগণ) দীন-ঈমানের প্রকৃত সত্য বিষয়ে অধিক অবগত ছিলেন। তাঁরা এ সকল বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন নি। বরং ঈমান-আকীদা বিষয়ক বিতর্ক তাঁরা পরিহার করতেন। তাঁরা শরীয়ত বা আহকাম বিষয়ে আলোচনা ও অধ্যয়নে লিপ্ত হতেন, এগুলোতে উৎসাহ দিতেন, শিক্ষা করতেন, শিক্ষা দিতেন এবং এ বিষয়ে বিতর্ক- আলোচনা করতেন। এজন্য আমি কালাম পরিত্যাগ করে ফিকহ চর্চায় মনোনিবেশ করি। আমি দেখলাম যে, কালাম বা দর্শনভিত্তিক আকীদা চর্চায় লিপ্ত মানুষগুলোর প্রকৃতি ও প্রকাশ নেককার মানুষদের মত নয়। তাদের হৃদয়গুলো কঠিন, মন ও প্রকৃতি কর্কশ এবং তারা কুরআন ও সুন্নাতের বিরোধিতা করার বিষয়ে বেপরোয়া। কালাম চর্চা যদি কল্যাণকর হতো তাহলে অবশ্যই পূর্ববর্তীগণ (সাহাবী-তাবিয়ীগণ) এর চর্চার করতেন।’’[1]

ইমাম যাহাবী উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফার শিক্ষা জীবনে ‘ইলমুল কালাম’-এর অস্তিত্বই ছিল না।[2] অর্থাৎ এ সময়ে দর্শন ভিত্তিক আকীদা চর্চা কোনো পৃথক ‘ইলম’ বা জ্ঞানে পরিণত হয় নি। কারণ ইমাম আবূ হানীফা ১০০ হিজরীর আগেই ফিকহ শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ইমাম যাহাবী বলেন:

فأفقه أهل الكوفة علي وابن مسعود، وأفقه أصحابهما علقمة، وأفقه أصحابه إبراهيم، وأفقه أصحاب إبراهيم حماد، وأفقه أصحاب حماد أبو حنيفة،

‘‘কূফার সর্বশ্রেষ্ঠ ফকীহ আলী (রা) এবং ইবন মাসঊদ (রা)। তাঁদের ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ আলকামা। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ ইবরাহীম নাখয়ী (৯৬ হি)। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান (১২০ হি)। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ আবূ হানীফা।’’[3]

উল্লেখ্য যে, ১২০ হিজরীতে ইমাম হাম্মাদের ওফাতের পর ইমাম আবূ হানীফা তাঁর স্থলাভিষিক্ত বলে গণ্য হন। এতে প্রমাণ হয় যে, এ সময়ের অনেক পূর্বেই ইমাম আবূ হানীফা কুফার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ বলে গণ্য হয়েছেন। এতে সুস্পষ্ট যে, ১০০ হিজরীর পূর্ব থেকেই তিনি ফিকহ শিক্ষা ও চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আর ১০০ হিজরীর পূর্বে মুসলিম বিশ্বে দর্শনভিত্তিক আকীদা চর্চা কোনো ‘ইলম’ বা শাস্ত্র হিসেবে প্রকাশ ও প্রসার লাভ করে নি। তাঁর পরিণত বয়সে (১১০-১৫০ হি) সমাজে ইলমুল কালাম চর্চা প্রসার লাভ করে এবং তিনি ইলমুল কালামের চর্চা থেকে তাঁর অনুসারীদেরকে নিষেধ করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর পুত্র হাম্মাদ বলেন:

أخذ أبو حنيفة رضي الله عنه بيدي يوم الجمعة، فأدخلني المسجد، .... مَرَّ بقوم يتنازعون في الدين، فقال: يا بنيَّ! إذا مهر في هذا الأمر، قيل: زنديق ، وأُخرِج من حَدِّ الإسلام، فيصير بحال لا ينتفع به. .... قال حماد بن أبي حنيفة: وكنتُ معجَبا بالمنازعة، فتركتُ المنازعةَ بعد قول الشيخ

এক শুক্রবারে আবূ হানীফা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আমার হাত ধরে মসজিদে প্রবেশ করেন। .... তিনি দীন (আকীদা) বিষয়ে বিতর্কে (কালাম চর্চায়) লিপ্ত একদল মানুষদের নিকট দিয়ে গমন করেন এবং আমাকে বলেন: বেটা, যে ব্যক্তি এ শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করবে সে যিনদ্দীক (ধর্মত্যাগী ও ধর্ম অবমাননাকারী) বলে আখ্যায়িত হবে এবং ইসলামের পরিমন্ডল থেকে বহির্ভূত বলে গণ্য হবে। এভাবে সে এমন অবস্থায় পৌঁছাবে যে, তার দ্বারা কোনো কল্যাণ সাধিত হবে না। .... হাম্মাদ ইবন আবী হানীফা বলেন: আমি এরূপ বিতর্কের বিষয়ে খুবই আগ্রহী ছিলাম। শাইখ (রা)-এর এ কথার পরে আমি এ জাতীয় বিতর্ক পরিত্যাগ করি।’’[4]

ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র নূহ ইবন আবী মরিয়ম বলেন:

قلت لأبي حنيفة رحمه الله ما تقول فيما أحدث الناس من كلام في الأعراض والأجسام فقال مقالات الفلاسفة عليك بالأثر وطريقة السلف وإياك وكل محدثة فإنها بدعة.

‘‘আমি আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহকে বললাম: মানুষেরা ইলমুল কালামে (স্রষ্টার অস্তিত্ব, অনাদিত্ব ও বিশেষণ প্রমাণে) ‘আরায’ (অমৌল-পরনির্ভর: nonessential), ‘জিসম’ (দেহ: body) ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনা উদ্ভাবন করেছে। এগুলোর বিষয়ে আপনার মত কী? তিনি বলেন: এগুলো দার্শনিকদের কথাবার্তা। তোমার দায়িত্ব হাদীসের উপর নির্ভর করা এবং পূর্ববতীদের (সাহাবী-তাবিয়ীদের) তরীকা অনুসরণ করা। সাবধান! সকল নব-উদ্ভাবিত বিষয় বর্জন করবে; কারণ তা বিদআত।’’[5]

ইমাম আযমের ছাত্রগণও এভাবে ইলমুল কালাম চর্চা নিষেধ করতে থাকেন। ইমাম আবূ ইউসূফ রাহ. (১৮৯ হি) তাঁর ছাত্র ইলমুল কালামের বিশেষজ্ঞ ও মু’তাযিলী পণ্ডিত বিশ্র আল-মারীসী (২১৮ হি)- কে বলেন:

اَلْعِلْمُ بِالْكَلاَمِ هُوَ الْجَهْلُ وَالْجَهْلُ بِالْكَلاَمِ هُوَ الْعِلْمُ، وَإِذَا صَارَ الرَّجُلُ رَأْساً فِيْ الْكَلاَمِ قِيْلَ: زِنْدِيْقٌ.

‘‘কালামের জ্ঞানই হলো প্রকৃত অজ্ঞতা আর কালাম সম্পর্কে অজ্ঞতাই হলো প্রকৃত জ্ঞান। ইলমুল কালামে সুখ্যাতির অর্থ তাকে যীনদীক বা অবিশ্বাসী-ধর্মত্যাগী বলা হবে।’’[6]

ইমাম আবূ ইউসুফ (রাহ) আরো বলেন:

مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ بِالْكَلاَمِ تَزَنْدَقَ

‘‘যে ব্যক্তি ইলমু কালাম শিক্ষা করবে সে যিনদীকে পরিণত হবে।’’[7]

ইমাম শাফিয়ী রাহ. (২০৪ হি) বলেন,

حُكْمِيْ فِيْ أَهْلِ الْكَلاَمِ أَنْ يُضْرَبُوا بِالْجَرِيْدِ وَالنِّعَالِ وَيُطَافُ بِهِمْ فِيْ الْعَشَائِرِ وَالْقَبَائِلِ وَيُقَالُ: هَذَا جَزَاءُ مَنْ تَرَكَ الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ وَأَقْبَلَ عَلَى الْكَلاَمِ.

‘‘যারা ইলমুল কালাম চর্চা করে তার বিষয়ে আমার বিধান এই যে, তাদেরকে খেজুরের ডাল ও জুতা দিয়ে পেটাতে হবে, এভাবে মহল্লায় মহল্লায় ও কবীলাসমূহের মধ্যে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে এবং বলতে হবে: যারা কিতাব ও সুন্নাত ছেডে ইলমুল কালামে মনোনিবেশ করে তাদের এ শাস্তি।’’[8]

এভাবে প্রসিদ্ধ চার মুজতাহিদ ইমাম এবং দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকের সকল প্রসিদ্ধ আলিম, ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ইলমুল কালামের নিন্দা করেছেন।[9]


কালামিদের তৎপরতা কি থেমে যায় নি। বরং এখন আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী এবং আরও বেশি সমৃদ্ধ এবং সম্প্রসারিত। আরবি কালামশাস্ত্র রেনেঁসার সময় পশ্চিমে পৌছে শক্তিশালী হতে থাকে। কালামশাস্ত্রের যুক্তি নৈতিক দর্শনের পাশাপাশি একটি অংশ হচ্ছে ন্যাচারাল ফিলসফি। এই বিদ্যা মূলত যাদুবিদ্যা বা অকাল্ট কিন্তু আগে সামগ্রিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন দিয়ে ন্যাচারাল ফিলসফি বলে ডাকা হত। ১৯শতকে এসে গ্রীক দর্শন নির্ভর কালাম বিদ্যা গুলো আলাদা ডিসিপ্লিনে ভাগ হতে শুরু হয়। ন্যাচারাল ফিলসফিকে নাম দেওয়া হয় "বিজ্ঞান"। এ নিয়ে "বিজ্ঞান নাকি অপবিজ্ঞান" সিরিজে বিস্তারিত আলোচনা করছি।  হার্মেটিক আলকেমি হয়ে যায় আলকেমিস্ট্রি। দর্শন থেকে আলাদা করবার পর এর প্রচার প্রচারণা চরম বেড়ে যায়। মুসলিমরা আলকেমি থেকে আলকেমিস্ট্রি হবার ইতিহাস অজানা কারনে ভুলে যায়, যাদুবিদ্যা উৎসারিত ব্যবিলনীয়ান-গ্রেসিয়ান কস্মোলজিকে শতভাগ গ্রহন করে। মূলত এই কুফরি আকিদানির্ভর তত্ত্বগুলো মুসলিমদের দ্বারা গ্রহন শুরু হয় আরবে কালামশাস্ত্রের আবির্ভাবের সময় থেকে। আজ আসারি আকিদার দাবিদাররাও কালামশাস্ত্রের বর্ধিত পরিপূর্ণ রূপের ফিতনাহ থেকে মুক্ত নয়। ৮০% আসারিরা আজ কালামশাস্ত্র দ্বারা প্রভাবিত। কেউ মারাত্মক কেউ-বা অল্প মাত্রায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা আসারি আশআরি মাতুরিদি, কোনকিছুই বোঝে না, জেনারেলে পড়ুয়া উচ্চ বা অর্ধশিক্ষিত, এরা সবচেয়ে বেশি দর্শনশাস্ত্র বা কালামি চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত। কালামশাস্ত্রের নব্য সংস্করণঃআধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে ভয়াবহ শাখা হচ্ছে পদার্থবিদ্যা এবং মহাকাশবিদ্যা। এটা সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যপারে সাহাবিদের আকিদার বিপরীতে হাটিয়ে লজিক্যালি মানুষের আকিদাকে একদম পাল্টে ফেলছে।অভিশপ্ত যাদুকরদের আকিদায় ফিরিয়ে যিন্দিক করে ফেলছে। আধুনিক মহাকাশবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যা পুরোপুরি গ্রীক-ব্যবিলনিয়ান অকাল্ট ফিলসফি থেকে উদ্ভূত। বিজ্ঞানের অন্যশাখা গুলো অল্পবিস্তর গ্রহনযোগ্যতা থাকলেও এই দুই শাখায় কোন কল্যান নেই।পদার্থবিজ্ঞানীরা গ্রীক ও ভারতীয় দর্শনে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি খোলাখুলি ভাবে বলে। তারা সরাসরি বলেন আধুনিক বিজ্ঞান আজ প্লেটোর দর্শনকে সত্যায়ন করে।  কিন্তু এরপরেও আজ ওইসব মুসলিমদের সংখ্যা বেশি যারা গ্রেসিয়ান দর্শন তথা ইল্মুল কালামের আধুনিক সংস্করণকে অমোঘ সত্য বানী হিসেবে গ্রহন করে। এরা আজ বিজ্ঞানকে কুরআন হাদিসের আগে রাখে। এদের চিন্তা, সবকিছুকে কেমন যেন বিজ্ঞানের চাকায় ঘোড়াতে হবে, কুরআন সুন্নাহকে বিজ্ঞান দ্বারা জাস্টিফাই করতে হবে। ইসলামের সবকিছুকে যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করতে হবে। এরা নব্য-কালামী। নব্য মু'তাযিলা। এদের কাছে যাদুবিদ্যা বলে কিছু নেই সবই সায়েন্স। এজন্য যে পদার্থবিজ্ঞান আকাশবিজ্ঞান কাব্বালার কাছে ফিরে গেছে সেটা আধুনিক মুসলিমদের কাছে বিশুদ্ধ সায়েন্স। কাব্বালিস্ট নিউটন,ভগবতগীতার অনুসারী আইনস্টাইন, বেদান্তবাদের অনুসারী শ্রোডিঞ্জার, হাইজেনবার্গ সবাই মহান বিজ্ঞানী। নিঃসন্দেহে ইল্মুল কালাম ইসলামের বাহিরের বিদআতি ইল্ম। আসারি আলিমদের সাথে গলা মিলিয়ে বলব এই কুফরি দর্শনের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এসব মানুষকে কুফর ও শিরকের দিকে চালিত করে। যে নির্বোধ কালামিরা আজ অপবিজ্ঞান তথা কালামশাস্ত্রের নতুন সংস্করণ ইসলামের সাথে সমন্বয় করে প্রচার প্রচারণা চালায়, যুক্তিনির্ভর কিতাব লেখে,  সবকিছুকে যুক্তি দিয়ে প্রমান করতে চায় এরা পরিত্যাজ্য।




টিকাঃ

[1] কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা, ৪৬৮।

[2] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯৮।

[3] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৩১-২৩৬।

[4] সায়িদ নাইসাপূরী হানাফী, আল-ই’তিকাদ, পৃষ্ঠা ১৭৭।

[5] হারাবী, আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ আনসারী, যাম্মুল কালাম ওয়া আহলিহী ৫/২০৬-২০৭।

[6] ইবন আবিল ইয্য হানাফী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৫

[7] ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৫

[8] ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৫

[9] গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/৩৩, ৫২-৫৩; ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭২-৭৭, ২০৪-২১০।

[10]
wikipedia.org/wiki/Kalam_cosmological_argument

[11]wikipedia.org/wiki/Jewish_Kalam

আরোও পড়ুনঃ https://i-onlinemedia.net/8125

2 Comments: