Sunday, August 16, 2020

আমাদের আক্বীদা ও মানহাজ

আমাদের আক্বীদা ও মানহাজ




শরীয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন
‘একটি পথ প্রদর্শনকারী কিতাব ও তাঁকে সাহায্যকারী একটি তরবারি’


হে তাওহীদে বিশ্বাসী ভাই!
আমরা এখানে আমাদের আক্বীদা ও মানহাজ নিয়ে আলোচনা করবো। আপনি স্মরণ রাখবেন, এগুলো শুধু কলম থেকে ঝরা কিছু কালি কিংবা মুখ-নিঃসৃত কিছু বুলি নয়। 
এটি আমাদের আক্বীদা, যা আমরা হৃদয়ের গভীর থেকে বিশ্বাস করি, অন্তর দ্বারা অনুভব করি, যার জন্য আমরা নিজেদের রক্ত ঝরাই এবং আমাদের জীবন উৎসর্গ করি।
এটি আমাদের মানহাজ, যার উপর আমরা নিজেরা চলি, যার কথা আমরা অন্যকে বলি। এটি ইলমের নূর দ্বারা আলোকিত এবং জিহাদের খুন দ্বারা রঞ্জিত একটি মানহাজ।
এই আক্বীদা ও মানহাজের ভিত্তিতেই আমরা একত্রিত হয়েছি, এর ভিত্তিতেই আমরা তাওহীদ ও জিহাদের পতাকাতলে সমবেত হয়েছি।
এর প্রতিটি বিষয়কে আপনি গুরুত্ব দেবেন; সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন। এর আলোকে নিজ জীবন গঠন করবেন। এই কামনায়- 
- উম্মাহর খেদমতে নিয়োজিত আপনার ভাইয়েরা।




بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
إِنَّ الْحَمْدَ لِلّٰهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنْ شُرُوْرِ أنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللّٰهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَنَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُه. أمابعد!
আমাদের আক্বীদা
# আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা
আমরা বিশ্বাস করি ও সাক্ষ্য দিই, আল্লাহ তা’আলা সবচেয়ে বড় ও মহান। তিনি ব্যতীত ইবাদতের যোগ্য কোন মাবূদ নেই। কেউ তাঁর সমকক্ষ নয়।
আমরা সাক্ষ্য দিই, এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই (لا إله إلا الله)। তাওহীদের এই বাণী যা কিছু দাবি করে, আমরা তাঁর জন্য তা-ই সাব্যস্ত করি। আমরা তাঁর সাথে শিরক করি না। যে সকল বাতিল মাবূদ বা তাগূতকে মানুষ আল্লাহর পরিবর্তে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করে, আমরা সেই সকল তাগুতকে অস্বীকার ও পরিত্যাগ করি এবং তাদের থেকে নিজেদের ‘বারাআত’ ও সম্পর্কহীনতার ঘোষণা দিই। 
আল্লাহ ব্যতীত যত কিছুর ইবাদত করা হয়, তার সবই তাগুত বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা এটাও বিশ্বাস করি, তাগুত বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন: 
১. শয়তান।
২. গায়েবের ইলম দাবীকারী। 
৩. আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করা হয় এবং সে ঐ ইবাদতে সন্তুষ্ট থাকে। 
৪. আল্লাহর আইন পরিবর্তনকারী শাসক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ 
৫. এবং যারা আল্লাহর আইন প্রত্যাখ্যান করে স্বরচিত অথবা মানবরচিত আইনে বিচার-ফায়সালা করে। ইত্যাদি।
এসবই তাগুত, এদেরকে অস্বীকার ও পরিত্যাগ (কুফর বিত-তাগুত) না করে আল্লাহর উপর ঈমান (ঈমান বিল্লাহ), ঈমান হিসেবে সাব্যস্ত হয় না এবং তা দ্বারা মুসলমান হওয়া যায় না। 
আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে- 
১. এসকল তাগুতের ইবাদত, আনুগত্য, অনুসরণ ও ভালবাসাকে কুফরী ও বাতিল বলে জানা; 
২. তাদের ইবাদত, আনুগত্য, অনুসরণ ও ভালোবাসা পরিত্যাগ করা; 
৩. তাদের প্রতি শত্রুতা রাখা এবং 
৪. তাদেরকে ঘৃণা করা 
ব্যতীত যথাযথভাবে ‘কুফর বিত-তাগুত’ (তাগুতকে অস্বীকার ও পরিত্যাগ) সাব্যস্ত হয় না। এর সবই পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।
আমরা বিশ্বাস করি- আল্লাহ তা’আলাই সবকিছুর স্রষ্টা ও পরিচালক, সকল ক্ষমতার উৎস একমাত্র তিনি; সকল প্রশংসার অধিকার কেবল তাঁরই। তিনিই সকল কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনিই শুরু, তিনিই শেষ; তিনিই (জাহির) প্রকাশ্য, তিনিই (বাতিন) গোপন ।
মহান আল্লাহর তাওহীদের ব্যাপারে আমরা বিশ্বাস করি, রব হিসেবে আল্লাহর কার্যাবলীতে, যেমন: সৃষ্টি, প্রতিপালন, রিযিক প্রদান, জীবন ও মৃত্যু দান, একচ্ছত্র মালিকানার অধিকার, বিশ্বজগত পরিচালনা, আইন-বিধান প্রদান, সার্বভৌমত্বের অধিকার, হালাল-হারাম নির্ধারণ, ভালো-মন্দ নির্ধারণ, বিপদ হতে মুক্তি দান, সন্তান দান, গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞান- ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে মহান আল্লাহকে একক ও অদ্বিতীয় (তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ) মেনে না নিলে মুসলমান হওয়া যায় না। 
আমরা আরো বিশ্বাস করি- রুকু, সিজদা, দোয়া, বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা (ইস্তেগাসাহ), কুরবানী, নযর-মান্নত ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদত শুধুমাত্র এক আল্লাহর অধিকার বলে মেনে না নিলে মুসলমান হওয়া যায় না। এগুলো ‘তাওহীদ ফিল-ইবাদাহ’র অংশ। 
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহতে আল্লাহ তা’আলার যে নাম ও সিফাতসমূহ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে আমাদের আক্বীদা হল- সেগুলো তাঁর শান অনুযায়ী বিদ্যমান, কোন মাখলুকের মতো নয়। আমরা আল্লাহ তা’আলার এই সিফাতগুলোকে মুশাব্বিহা ফেরকার (المشبهة) মতো কোন মাখলুকের সদৃশ মনে করি না এবং মুয়াত্তিলা ফেরকার (المعطلة) মতো তাঁর কোন সিফাতকে অস্বীকারও করি না।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র দু’টি ভাগ- নফী ও ইসবাত তথা ‘কুফর বিত-তাগুত; ও ‘ঈমান বিল্লাহ’-এর কোনটিতে কোন প্রকার শিথিলতা গ্রহণযোগ্য নয়। 
আমরা বিশ্বাস করি- 
১. এই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র যথাযথ জ্ঞান (ইলম) থাকা,
২. এতে দৃঢ় বিশ্বাস (ইয়াক্বীন) রাখা, 
৩. অন্তর থেকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ (কবুল) করা,
৪. মুখে স্বীকারোক্তি (ইকরার) দেয়া,  
৫. বাস্তব জীবনে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর’-এর উপর আমল করা, এর বিপরীত না করা,
৬. এবং সততা (সিদক) ও নিষ্ঠার (ইখলাস) সাথে এই কালেমার উপর আমৃত্যু টিকে থাকা, 
যে কোন ব্যক্তির মুসলমান থাকার জন্য জরুরী।



# সম্মানিত ফেরেশতাগণ #
আমরা সম্মানিত ফেরেশতাগণের উপর ঈমান রাখি। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁরা আল্লাহর সম্মানিত মাখলূক, আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে যে নির্দেশ দেন তাঁরা তার অবাধ্য হন না। যে নির্দেশ তাঁদেরকে দেয়া হয় তাঁরা তাই বাস্তবায়ন করেন।
ফেরেশতাদেরকে ভালোবাসা ঈমানের অংশ। তাদের প্রতি শত্রুতা কুফরির অন্তর্ভুক্ত।



# কিতাবুল্লাহ #
আমরা বিশ্বাস করি, আল-কুরআন আল্লাহ তাআলার কিতাব এবং তাঁর নিজের কালাম বা কথা। কুরআনে কারীমের শব্দ ও অর্থ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আল্লাহ তাআলা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যেভাবে পাঠিয়েছেন ঠিক সেভাবেই এসেছে এবং আজ পর্যন্ত হুবহু সেভাবেই সংরক্ষিত আছে। তার একটি নুকতাও পরিবর্তন হয়নি এবং কেয়ামত পর্যন্ত হবে না। তাকে সম্মান করা আবশ্যক। তার অনুসরণ জরুরী। সে অনুযায়ী ফায়সালা করা ফরয।
আমরা পূর্ববর্তী নবীগণের (আলাইহিমুস সালাম) উপর যে কিতাবসমূহ নাযিল হয়েছিল তার উপরও বিশ্বাস রাখি। একই সঙ্গে বিশ্বাস রাখি- সায়্যিদুনা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) নুবুওয়াতের মাধ্যমে ঐ সকল কিতাব ও সহীফা রহিত হয়ে গেছে। 
দ্বীন ইসলাম গ্রহণ না করে পূর্ববর্তী নবীগণের (আলাইহিমুস সালাম) কিতাব- তাওরাত কিংবা ইঞ্জীল (অবিকৃত হলেও) [যদিও বর্তমান পৃথিবীতে অবিকৃত তাওরাত বা ইঞ্জীল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়] অনুসরণ করেও কেউ মুমিন হতে পারবে না। তারা নিশ্চিত জাহান্নামী হবে। তাদের সবাইকে আমরা সুস্পষ্ট কাফের মনে করি। তাদেরকে কাফের বলতে আমরা কোন প্রকার দ্বিধা করি না- যেমনটা বর্তমান যুগের ‘মর্ডানিষ্ট’ চিন্তা-ধারার বিদআতিরা করে থাকে।



# সম্মানিত নবী-রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাতু ওয়াসসালাম) #
আমরা আল্লাহ তা’আলার সকল নবী ও রাসূলের উপর ঈমান রাখি। তাঁদের সর্বপ্রথম হলেন সায়্যিদুনা আদম (আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালাম)। সর্বশেষ হলেন সায়্যিদুল মুরসালিন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
আম্বিয়ায়ে কিরাম আল্লাহর বান্দা এবং পরস্পর ভাই ভাই। তাঁদেরকে আল্লাহ তা’আলা তাওহীদের বাণী পৌঁছানোর জন্য প্রেরণ করেছেন।
আমরা নবী-রাসুলগণের (আলাইহিমুস সালাম) প্রতি ঈমানের ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরের মাঝে কোন পার্থক্য করি না (অর্থাৎ ইয়াহুদী-খ্রীষ্টানরা যেমন কারো প্রতি ঈমান রাখে আর কাউকে অস্বীকার করে- আমরা তা করি না)। এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা ব্যতীত একজনের উপর আরেকজনকে প্রাধান্য দিই না ।
নবী-রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম) সকলেই মাটির তৈরী, কেউই নূরের তৈরী নন।



# হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম #
আমরা বিশ্বাস করি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষ ও জ্বীন সকলের জন্য প্রেরিত আল্লাহ তা’আলার রাসূল। তিনি সায়্যিদুল মুরসালিন ও খাতামুন নাবিয়্যিন। তাঁর পরে কোন নবী আসবেন না। কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর উপর নাযিল হওয়া বিধানই চূড়ান্ত বিধান। কেয়ামতের পূর্বে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আসমান থেকে অবতরণ করবেন, কিন্তু নবী হিসেবে নন; আসবেন শেষ নবীর উম্মত ও তাঁর শরীয়তের অনুসারি হিসেবে। 
আমরা বিশ্বাস করি, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর উপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব পরিপূর্ণ ও যথাযথ পালন করেছেন। তিনি ওহীর কোন অংশ গোপন করেনি কিংবা বিশেষভাবে কাউকে দিয়ে যান নি,  যেমন শিয়াদের কতক গোষ্ঠী এবং কিছু মুলহিদ পীর ধারণা করে থাকে।
দ্বীন হিসেবে তিনি আমাদেরকে যা দিয়েছেন, তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে দিয়েছেন।
আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর আনুগত্য আল্লাহর ভালবাসার পূর্বশর্ত এবং আমাদের সকল ইবাদত তাঁর সুন্নাহ অনুযায়ী হওয়া জরুরী। 
তিনি দৃশ্য-অদৃশ্য, অতীত ও ভবিষ্যতের যে সকল বিষয়ে সংবাদ দিয়েছেন, তা বিশ্বাস করা এবং তার সামনে আত্মসমর্পণ করা জরুরী।
আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসি এবং এই ভালোবাসাকে ঈমানের অংশ এবং রবের সন্তুষ্টির মাধ্যম মনে করি। আমরা আহলে বাইতকেও (নবী পরিবারের সকল সদস্য) ভালোবাসি। তাঁদেরকে সম্মান করি।
আমরা জীবনের সকল অঙ্গনে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে উত্তম আদর্শ মনে করি। তাঁর আদর্শ ও শিক্ষার বিপরীতে অন্য যে কোন জাতীয়-বিজাতীয় নেতা, দার্শনিক কিংবা বিজ্ঞানীর কোন শিক্ষা কিংবা আদর্শকে প্রাধান্য দেয়া কুফরী মনে করি- যা বর্তমান যুগের বিভিন্ন জাতীয়তবাদি, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দলগুলো অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি অঙ্গনে করে থাকে।
ব্যক্তিগত জীবন থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন, আইন-আদালত ও বিচারকার্যসহ সকল ক্ষেত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ অনুযায়ী পরিচালনা করাকে আমরা আবশ্যক মনে করি। বিশেষ করে আইন আদালত ও বিচারকার্যে তাঁর বিধান অমান্য করা ঈমান ভঙ্গের কারণ মনে করি।



# সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) #
আমরা সকল সাহাবায়ে কেরামকে (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) ভালবাসি, তাদের সকলের প্রতি সুধারনা পোষণ করি। তাঁরা সকলেই ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। আমরা তাঁদের ব্যাপারে ভাল ব্যতীত অন্য কিছু বলি না।
তাঁদেরকে ভালোবাসা ঈমানের অংশ, তাঁদের সাথে শত্রুতা রাখা মুনাফিকী।
তাঁদেরকে আমরা সত্যের মাপকাঠি (মি’য়ারে হক্ব) মনে করি। আক্বীদা-বিশ্বাস, মানহাজ-কর্মপন্থা: যে কোন বিষয়ে আমরা তাদের অবস্থানকেই সঠিক মনে করি এবং তাঁদেরই অনুসরণ করি। 
তাঁদের জীবনকেই আমরা আদর্শ জীবন মনে করি। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক- যে কোন সমস্যার সমাধানে তাঁরা যে কর্মনীতি অবলম্বন করেছেন, সেটাকে আমরা অন্য যে কোন যুগের ইসলামী যে কোন দল বা নেতার অনুসৃত পদ্ধতির উপরে প্রাধান্য দিই। 
তাঁদের পারস্পরিক মতভেদের ব্যাপারে আমরা নীরবতা অবলম্বন করি। আমরা মনে করি, এ সকল মতভেদের ক্ষেত্রে তাঁরা ইজতিহাদের ভিত্তিতে দলীলের আলোকে যা সঠিক মনে করেছেন, তার উপর আমল করেছেন। কেউই প্রবৃত্তির অনুসরণ করেননি। 
একইভাবে তাঁদের যথাযথ অনুসরণকারী তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনকেও (রাহিমাহুমুল্লাহু জামিয়া) আমরা অনুসরণযোগ্য মনে করি। বিভিন্ন বিদআতি ফিরকা ও মতবাদের (যেমন: খারেজী, মুরজিয়া ইত্যাদি) মোকাবেলায় আমরা তাদের অবস্থানকে নিজেদের পক্ষে দলীল হিসেবে ব্যবহার করি।



# তাক্বদীর #
আমরা বিশ্বাস রাখি তাক্বদীরের উপর, এর ভালো ও মন্দের উপর এবং এও বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না। 
তাক্বদীরের ভাল-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। বান্দার সকল কাজ তিনি আগে থেকেই জানেন এবং লিখে রেখেছেন। সেই লেখা অনুযায়ী সব কিছু সংগঠিত হয়; ন্যূনতম ব্যত্যয় ঘটার অবকাশ নেই।  
বান্দার সকল কাজের স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা। এক্ষেত্রে আমরা জবরিয়া ফেরকার বাড়াবাড়ি প্রত্যাখ্যান করি, যারা বান্দাকে কোন কাজের জন্য দায়ী মনে করে না; আবার ক্বাদরিয়াদের মতো এটাও বলি না যে, বান্দার কাজের স্রষ্টা সে নিজেই। এক্ষেত্রে আমরা দুই ফেরকার মাঝামাঝি আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআহ’র আক্বীদা পোষণ করি।
# কবরের আযাব ও সওয়াল-জওয়াব #
আমরা বিশ্বাস রাখি, কবরে মুনকার-নাকির দু’জন ফেরেশতা রব, দ্বীন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। 
আমরা বিশ্বাস রাখি, কবরের আযাব সত্য। আল্লাহ তা’আলা সকল কাফেরকে এবং কতক গুনাহগার মুসলমানকে কবরে শাস্তি প্রদান করবেন আবার যখন তিনি ইচ্ছা করেন, মুসলমানকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন। একইভাবে তিনি নেক বান্দাকে কবরে পুরস্কৃত করবেন এবং তার আরামের ব্যবস্থা করবেন।



# কেয়ামত #
আমরা বিশ্বাস করি কেয়ামতের নিদর্শন সমূহের উপর, যা কুরআনে কারীমে এসেছে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিভিন্ন হাদীসে বর্ণনা করেছেন।
আমরা বিশ্বাস করি, কেয়ামতের পূর্বে আল-মাহদীর আগমন ঘটবে এবং বিশ্বাস করি কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জালেরও আবির্ভাব ঘটবে।
আমরা বিশ্বাস করি, ঈসা আলাইহিস সালাম মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধর্মের অনুসারী হয়ে আবার অবতরণ করবেন। পৃথিবীতে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন, খ্রিস্টানদের মিথ্যা ও হঠকারি ধর্মবিশ্বাসকে বাতিল সাব্যস্ত করবেন, তাদের ক্রুশ ধ্বংস করে দেবেন এবং জিজিয়ার বিধান তুলে দেবেন। 
আমরা বিশ্বাস করি, কেয়ামতের পূর্বে পুনরায় নবুওয়াতের আদলে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। 
আমরা বিশ্বাস স্থাপন করি কেয়ামত সংঘঠিত হবে, যেভাবে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।



# পুনরুত্থান ও আখিরাত #
আমরা বিশ্বাস করি, মৃত্যুর পর সকল প্রাণী পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হবে।
আমরা বিশ্বাস করি, হাশরের ময়দানে বিচার দিবস কায়েম হবে এবং আল্লাহ সকলের হিসাব নেবেন। 
আমরা আরও বিশ্বাস করি, হাশরের ময়দানে বান্দার আমল ওজন করার জন্য মিজান স্থাপন করা হবে; হাউজে কাউছার থাকবে এবং জাহান্নামের উপর পুলসিরাত স্থাপিত হবে।
আমরা বিশ্বাস করি জান্নাত এবং জাহান্নাম সত্য; যেমন কুরআন-হাদীসে তার বিবরণ এসেছে।



# শাফাআত #
আমরা বিশ্বাস করি, তাওহীদের অনুসারী যে সকল ব্যক্তি জাহান্নামে যাবেন, সুপারিশকারীদের সুপারিশের মাধ্যমে তাঁরা আবার জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
এই সুপারিশের অধিকার তাঁরাই পাবেন, যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করবেন এবং সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন।
আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তাআলা হাশরের ময়দানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাকামে মাহমূদ দান করবেন। তিনি বিচারের জন্য আ’ম শাফাআত করবেন এবং মুমিনদের জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য খাছ শাফাআত করবেন।



# শিরক #
আমরা বিশ্বাস করি, শিরক হচ্ছে তাওহীদের বিপরীত।
ধরন ও প্রকৃতির দিক থেকে শিরক বিভিন্ন প্রকার হতে পারে যেমন: 
১. ‘শিরক ফির-রুবূবিয়্যাহ্’: রব হিসেবে আল্লাহর কার্যাবলী, যেমন: সৃষ্টি, প্রতিপালন, রিযিক প্রদান, জীবন ও মৃত্যু দান, একচ্ছত্র মালিকানার অধিকার, বিশ্বজগত পরিচালনা, আইন ও বিধান প্রদান, সার্বভৌমত্বের অধিকার, হালাল-হারাম নির্ধারণ, ভালো-মন্দ নির্ধারণ, বিপদ হতে মুক্তি দান, সন্তান দান, গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞান- ইত্যাদি কোন বিষয়ে মহান আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করা ‘শিরক ফির-রুবূবিয়্যাহ্’ তথা মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শিরক। 
২. ‘শিরক ফিল-উলূহিয়্যাহ্’: সিজদা, দোয়া, বিপদমুক্তির প্রার্থনা (ইস্তেগাসাহ), কুরবানী, নযর-মান্নত ইত্যাদি যে কোন প্রকার ইবাদতে মহান আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার করা ‘শিরক ফিল-উলূহিয়্যাহ্’ তথা মহান আল্লাহর উলূহিয়্যাতে শিরক। 
৩. ‘শিরক ফিল-আসমা ওয়াস-সিফাত’: পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ’তে আল্লাহ তা’আলার যে নাম ও সিফাতসমূহ বর্ণিত হয়েছে, সেই নাম ও সিফাতগুলোর মধ্যে যেগুলো শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট বা খাছ, সেগুলোতে অন্য কাউকে শরীক করা ‘শিরক ফিল-আসমা ওয়াস-সিফাত’ তথা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে শিরক।
আমরা আরো বিশ্বাস করি, বিধানের দিক থেকে শিরক দুই প্রকার: 
১. ‘শিরকে আকবার’ তথা বড় শিরক, যার দ্বারা একজন মুসলিম ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়।
২. ‘শিরকে আসগার’ তথা ছোট শিরক, যার দ্বারা একজন মুসলিম ইসলাম থেকে বের হয় না। তবে যে কোন ছোট শিরকও গুনাহে কবিরা থেকে গুরুতর।
আমরা আরো বিশ্বাস করি, শিরক আক্বীদা-বিশ্বাসের মাধ্যমে যেমন হতে পারে, কথা ও কাজের মাধ্যমেও হতে পারে।





# কুফর ও নাওয়াকিযুল ঈমান (ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ) #
ঈমান যেমন কথা, কাজ ও বিশ্বাসের নাম; কুফরও তেমনি হতে পারে কথা, কাজ ও বিশ্বাসের মাধ্যমে।
শিরকের মতো বিধানের দিক থেকে কুফরও দুই প্রকার: 
১. কুফরে আকবার তথা বড় কুফর, যার দ্বারা একজন মুমিন ঈমান থেকে বের হয়ে যায়। 
২. কুফরে আসগার তথা ছোট কুফর, যার দ্বারা একজন মুমিন ঈমান থেকে বের হয় না।  
বড় কুফর বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যথা- 
১. (كفر العناد) তথা সত্য দ্বীন চেনার পরও জেনেশুনে একগুঁয়েমি বা জেদ বশত তা গ্রহণ না করা। 
২. (كفر الإنكار والتكذيب) তথা মুখে বা অন্তরে দ্বীন অথবা দ্বীনের অকাট্য কোন বিষয়কে অস্বীকার করা।  
৩. (كفر الاستكبار) তথা সত্য দ্বীন চেনার পরও অহংকার বশত তা গ্রহণ না করা।  
৪. (كفر الجحود) তথা অন্তরে সত্য চেনা ও বিশ্বাস করা সত্ত্বেও মুখে অস্বীকার করা।  
৫. (كفر النفاق) তথা অন্তরে সত্য দ্বীনকে অস্বীকার করে বাহ্যিকভাবে স্বীকার করা। 
৬. (الاستحلال كفر) তথা শরীয়তের কোন হালালকে হারাম বা কোন হারামকে হালাল মনে করা। 
৭. (كفر الكره والبغض) তথা দ্বীন অথবা দ্বীনের কোন প্রমাণিত বিষয় অপছন্দ ও ঘৃণা করা। 
৮. (كفر الطعن والإستهزاء) তথা দ্বীনের কোন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ বা উপহাস করা কিংবা দ্বীনের কোন বিধানকে দোষারোপ করা।
৯. (كفر الإعراض) তথা দ্বীন থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ থাকা অর্থাৎ ঈমানদার হওয়ার জন্য আবশ্যকীয় বিষয়গুলোও না জানা, না শিখা কিংবা গ্রহণ না করা। যেমন- জন্মসূত্রে মুসলিম কোন ব্যক্তির পিতা-মাতা কোন দিন তাকে ঈমান-ইসলাম শিখায়নি, সে নিজেও তা শিখেনি। 
শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কিছু কাজ আছে, যেগুলোকে শরীয়ত বড় কুফর সাব্যস্ত করেছে এবং সেটি কুফর হওয়ার জন্য তা হালাল মনে করা কিংবা রদ্ তথা শরয়ী বিধান প্রত্যাখ্যান করার শর্ত আরোপ করেনি। যেমন: 
- সূর্য বা কোন প্রতিমার সিজদা করা। 
- আল্লাহ, দ্বীন বা কোন নবী-রাসূলের (আলাইহিমুস সালাম) অবমাননা করা। 
- দ্বীনের কোন বিষয় নিয়ে উপহাস বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। 
- এমন আইন প্রণয়ন বা প্রবর্তন, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি ইত্যাদি। 
এসকল বড় কুফরের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায়, যদিও সে একে হালাল মনে না করে, বরং নাজায়েয ও হারাম মনে করে। 
আমরা বিশ্বাস করি, নিম্নোক্ত প্রতিটি কর্ম কুফর ও শিরকে আকবার-
১. তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্বে অন্য কাউকে শরীক করা। 
২. ইয়াহুদী-খ্রিস্টান, হিন্দু-বৌদ্ধ বা এরকম অন্য কোন কাফেরে আছলিকে কাফের মনে না করা বা তাদের ধর্মকে ভ্রান্ত মনে না করা কিংবা ভ্রান্তির ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় রাখা। 
৩. সায়্যিদুনা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত শরীয়তের কোন বিধানের প্রতি সন্তুষ্ট না থাকা। 
৪. এই শরীয়তের কোন বিধান থেকে অন্য কোন দ্বীন, আদর্শ বা বিধানকে ‍উত্তম, যুক্তিযুক্ত বা অধিক পরিপূর্ণ মনে করা। 
৫. শরীয়তের কোন বিধানকে ঘৃণা করা। 
৬. শরীয়তের কোন বিধান নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা। 
৭. শিরক-কুফর মিশ্রিত জাদু করা। 
৮. মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফের-মুশরেকদেরকে সাহায্য করা। 
৯. এই শরীয়তকে পরিপূর্ণ মনে না করা, এর মধ্যে কিছু যোগ-বিয়োগ করার সুযোগ আছে মনে করা। 
১০. দ্বীন থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ থাকা অর্থাৎ ঈমানদার হওয়ার জন্য আবশ্যকীয় বিষয়গুলোও না জানা, না শিখা কিংবা গ্রহণ না করা। যেমন- জন্মসূত্রে মুসলিম কোন ব্যক্তির পিতা-মাতা কোন দিন তাকে ঈমান-ইসলাম শিখায়নি, সে নিজেও তা শিখেনি।
এমনসব ‘নাওয়াক্বিযুল ঈমান’ তথা ঈমান ভঙ্গকারী কর্মের কোন একটাতে লিপ্ত হলে ব্যক্তির ঈমান নষ্ট হয়ে যায়, সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায়। 
“কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত কাফের হবে না, যতক্ষণ না সে তার অন্তর দিয়ে অস্বীকার করে”- এই কথাটি নব-উদ্ভাবিত একটি বিদআত।
যুগের মুরজিয়া ও জাহমিয়া ফেরকার আকীদা থেকে আমরা নিজেদেরকে মুক্ত ঘোষণা করি, যারা বিশ্বাস করে- ‘কুফর শুধু অন্তর দিয়ে প্রত্যাখ্যান ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার মাঝেই সীমাবদ্ধ; অন্তরে আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত থাকলে কথা-কাজের দ্বারা কখনও কাফের হয় না।’



# নিফাক #
আমরা বিশ্বাস করি, মুনাফিকরা কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্ট। তারা দোযখের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ভয়াবহ স্তরে থাকবে। 
আমরা আরো বিশ্বাস করি, নিফাক দুই প্রকার- 
১. নিফাকে ই’তিকাদী বা আকীদা-বিশ্বাসগত নিফাক। এটা বড় নিফাক। 
২. নিফাকে আমলী তথা কর্মগত নিফাক। এটা ছোট নিফাক
১. নিফাকে ই’তিকাদী বা বড় নিফাক: এতে মুনাফিক ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে ইসলাম প্রকাশ করে কিন্তু অন্তরে কুফর গোপন রাখে। এ প্রকারের নিফাক ব্যক্তিকে সম্পূর্ণরূপে দ্বীন থেকে বের করে দেয়। 
নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর সবক’টি আক্বীদাগত তথা বড় নিফাক:
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা তাঁর আনীত শরীয়তের কোন বিষয় বা বিধানকে মিথ্যা জ্ঞান করা। 
- রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কিংবা তাঁর আনীত দ্বীনের কোন বিষয় বা বিধানের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা। 
- তাঁর আনীত দ্বীনের পতনে খুশী এবং এর বিজয়ে অখুশী হওয়া ও কষ্ট অনুভব করা- ইত্যাদি।
২. নিফাকে আমলী তথা ছোট নিফাক হল- অন্তরে ঈমান রাখার পাশাপাশি মুনাফিকদের মতো কাজে লিপ্ত হওয়া, যেগুলো কুফরে আকবার নয়। যেমন- বিবাদ হলেই গালি-গালাজ করা, কথায় কথায় মিথ্যা বলা ইত্যাদি। এ নিফাকীর ফলে ব্যক্তি ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয় না, তবে এগুলো মারাত্মক গুনাহ।






# বাতিল মতবাদ #
আমরা নিম্নোক্ত মতবাদসমূহকে এবং এগুলোর অনুরূপ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মতবাদকে সুস্পষ্ট কুফরী হিসাবে আখ্যায়িত করি-
গণতন্ত্র
সমাজতন্ত্র
জাতীয়তাবাদ
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
মুক্তচিন্তা
অসাম্প্রদায়িক চেতনা

# গণতন্ত্র (Democracy) #
গণতন্ত্র হল জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে রাষ্ট্র শাসন-ব্যবস্থা, যেখানে সার্বভৌমত্ব জনগণের এবং এর প্রয়োগ ঘটে জনপ্রতিনিধিদের আইন প্রনয়নের মাধ্যমে। গণতন্ত্রে আল্লাহর শরীয়তের কোন মূল্য নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সংসদ সদস্যরা যে আইন প্রণয়ন বা প্রবর্তন করবে সেটাই আইন, সেটাই পালনীয়। আল্লাহর শরীয়ত কি বলে তা গণতন্ত্রে দেখার বিষয় নয়। গণতন্ত্রের ভিত্তি ‘ফাসলুদ দ্বীন আনিদ দাওলা’- ‘রাষ্ট্র থেকে ধর্ম পৃথকীকরণ’ নীতির উপর। তাই তাদের স্লোগান- ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’, ‘রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই’ ইত্যাদি। জনগণ কিংবা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক। তাদের ইচ্ছা ও খাহেশ এবং তাদের অভিব্যক্তিই চূড়ান্ত আইন। তারা তাদের ইচ্ছা মতো আল্লাহর বিধান পরিবর্তন করে। হারামকে হালাল করে, হালালকে হারাম করে। যেমন:
- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চুরির শাস্তি হাত-কাটা সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থায় এর পরিবর্তে জেল-জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটিই হচ্ছে আল্লাহর বিধান পরিবর্তন। 
- আল্লাহ তাআলা সুদ হারাম করেছেন এবং সুদখোরদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থায় সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ও আর্থিক লেনদেনকে বৈধতা দেয়া হয়েছে, এর জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। গোটা অর্থব্যবস্থার ভিত্তি এর উপরই স্থাপন করা হয়েছে। এ হচ্ছে হারামকে হালালকরণ।
- আল্লাহ তাআলা জিহাদ ফরয করেছেন। কিন্তু গণতন্ত্রে একে সন্ত্রাস এবং মানবতাবিরোধি জঘন্য অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ হচ্ছে হালালকে হারামকরণ। 
এভাবে আল্লাহর বিধান পরিবর্তন কিংবা হালালকে হারাম বা হারামকে হালালকরণ সুস্পষ্ট শিরক ও কুফরে আকবার। যেমন-  কোন শাসক যদি আইন প্রবর্তন করে যে, ‘আল্লাহর শরীয়তে যদিও আসরের নামায চার রাকাআত ফরয এবং আমরাও তা অস্বীকার করি না, কিন্তু আমাদের দেশে এখন থেকে আসরের নামায দুই রাকাত পড়তে হবে। চার রাকাআত পড়া দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে’- তাহলে এমন শাসক নিশ্চিত কাফের। শরীয়তের বিধান তথা ‘আসরের নামায চার রাকাত ফরয’ স্বীকার সত্ত্বেও সে কাফের। যারা নামায পরিবর্তন করে-তারা, আর যারা যিনা, চুরি ইত্যাদির শরীয়ত-নির্ধারিত অকাট্য শাস্তি পরিবর্তন করে-তাদের মধ্যে কোনই ব্যবধান নেই। সকলেই কাফের ও মুরতাদ।  
দ্বিতীয়ত এই শাসন-ব্যবস্থায় আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আনুগত্য বর্জন করা হয়। তাঁর নাযিলকৃত দ্বীন ও শরীয়ত প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর বিপরীতে তাগুত, শয়তান ও গাইরুল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত করা হয়। এদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, খেয়াল-খুশি ও খাহেশ-প্রবৃত্তির ভিত্তিতে রচিত আইন-কানুন ও বিধি-বিধানকে জীবন-বিধানরূপে গ্রহণ করা হয়। আল্লাহর আইন পরিবর্তনের মতো তা এই মানবরচিত বিধানকে জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করাও সুস্পষ্ট শিরক ও কুফরে আকবার। 
শরয়ী শাসনের বিপরীতে যারা এই শাসন-ব্যবস্থা প্রণয়ন বা প্রবর্তন করে, তারা কাফের। 
শরীয়তের পরিবর্তে এই শাসন-ব্যবস্থা দ্বারা যেসব শাসক রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তারাও কাফের। 
মন্ত্রী এম.পি এবং আইন প্রণয়ন সংস্থার সদস্য- যারা এই কুফরী আইন প্রণয়ন বা প্রবর্তনে লিপ্ত, তারাও কাফের। 
যেসব বাহিনী শক্তিবলে এই কুফরী শাসন-ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে চলেছে, এর হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে, এর প্রহরায় নিয়োজিত আছে, তারাও কুফরে আকবারে লিপ্ত। 
এই শাসন-ব্যবস্থার স্বরূপ সুস্পষ্ট হওয়ার পরও যারা এর প্রতি সন্তুষ্ট, এর সমর্থক, প্রচারক এবং যারা জনশক্তি বা আর্থিক যোগান দিয়ে কিংবা অন্য কোন উপায়ে এর সাহায্য-সহযোগিতা করবে, শক্তি যোগাবে, এসব দলকে ভোট দেবে- তারাও কুফরে আকবারে লিপ্ত। 
উল্লেখ্য, এসব কারণে সুনিদৃষ্টভাবে কোন ব্যক্তির উপর কুফর ও ইরতিদাদের হুকুম আরোপ করার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অজ্ঞতা (الجهل), তাবীল  (التأويل) ইত্যাদির মত  موانع التكفيرতথা তাকফীরের প্রতিবন্ধক বিষয়গুলো লক্ষ্যনীয়। হক্কানী বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামই কেবল এ ব্যাপারে ফায়সালা দেয়ার অধিকার রাখেন। জনসাধারণের জন্য আবশ্যক উলামায়ে কেরামের আনুগত্য করা।

# সমাজতন্ত্র (Communism) #
সমাজতন্ত্র একটি বস্তুবাদি মতবাদ, যা পরিপূর্ণ নাস্তিকতার উপর গড়ে উঠেছে। এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়াহুদী কার্ল মার্ক্স ও তার সাহায্যকারী ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। সমগ্র মানব ইতিহাস ও কর্মকান্ডকে “শ্রেণী সংগ্রামের” নিরিখে দেখা, এ মতবাদের মূলনীতি হচ্ছে- আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করা, সকল নবী-রাসূলকে মিথ্যারোপ করা, সকল দ্বীনের সাথে কুফরী করা, ধর্মীয় সকল আকিদা ও তার নির্দেশিত আচরণকে অস্বীকার করা। ধর্ম ও আচার-আখলাককে তারা অর্থনৈতিক উন্নতির অন্তরায় মনে করে। এর প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্কস ধর্মকে আফিম বলে আখ্যায়িত করেছে। এ মতবাদ ব্যক্তি মালিকানা অস্বীকার করে এবং সব কিছুকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি গণ্য করে। এটি একটি কুফরী মতবাদ হওয়ার ব্যাপারে সকলেই অবগত।

# জাতীয়তাবাদ (Nationalism) #
আল্লাহ তাআলা মানব জাতীকে বিভক্ত করেছেন ঈমান ও কুফরের ভিত্তিতে। সকল ঈমানদার-মুসলমান এক জাতি, আর সকল কাফের-অমুসলিম এক জাতি। মুসলমান পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক, যে জাতি-গোষ্ঠী ও রঙ-বর্ণেরই হোক, যে ভাষাতেই কথা বলুক- তারা পরস্পর ভাই ভাই। তারা পরস্পর ঈমানী বন্ধন ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ। তাদের পরস্পর মহব্বত, ভালবাসা ও বন্ধুত্ব রাখা আবশ্যক। একে অপরকে নুসরত করা, হেফাজত করা, কাফের-মুশরেকদের হাত থেকে রক্ষা করা, তাদের বিরুদ্ধে একে অপরকে সহায়তা করা জরুরি। অপরদিকে অমুসলিমকে ভালোবাসা, তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সর্বোচ্চ তার সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে মানবিক সহমর্মিতার সুযোগ রয়েছে। মোটকথা, ইসলামে ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ (শত্রুতা-মিত্রতা) ঈমান ও কুফরের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। একে যদি জাতীয়তাবাদ বলা হয়, তাহলে ইসলাম এ জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি দেয়। একে বলা যেতে পারে ইসলামী জাতীয়তাবাদ, যার মূল ভিত্তি হবে ঈমান ও কুফর।
পক্ষান্তরে প্রচলিত জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে দেশ, জাতি, গোত্র, অঞ্চল, ভাষা, রঙ, বর্ণ ও সংস্কৃতি ইত্যাদির ভিত্তিতে। তাদের ‘ওয়ালা-বারা’ তথা মহব্বত-ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা, ঐক্য-অনৈক্য সব কিছু এসবের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত। সেখানে ঈমান ও কুফরে তফাৎ নেই। মুসলিম অমুসলিমের কোন পার্থক্য নেই।  মুসলমান-কাফের, ইয়াহুদ-নাসারা, হিন্দু-বৌদ্ধ, নাস্তিক-মুরতাদ কারো মাঝে কোন ব্যবধান নেই। যতক্ষণ তারা এক দেশ, এক জাতি কিংবা এক ভাষাভাষী হবে, ততক্ষণ তাদেরকে ভালবাসতে হবে, তাদের সাহায্য-সহায়তা করতে হবে, ন্যায়-অন্যায় সব কিছুতেই তাদের পক্ষাবলম্বন করতে হবে। তাদের কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতি, প্রথা-প্রচলন, ইচ্ছা-অভিলাষ, খাহেশ-প্রবৃত্তি সব কিছুকেই সংরক্ষণ করতে হবে। তা সঙ্গত কি অসঙ্গত, শরীয়তসম্মত কি শরীয়তবিরোধি- এসব দেখার সুযোগ নেই। এভাবে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে শরীয়তের বিধান পরিবর্তিত হচ্ছে; হারাম হালাল হচ্ছে, হালাল হারাম হচ্ছে। 
উল্লেখ্য, বর্তমানে এই জাতীয়তবাদের ধ্বজাধারীদের মূল উদ্দেশ্য, পৃথিবী থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের শাসন ও কর্তৃত্ব মুছে ফেলা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য মুসলমানদের ঐক্য ও একতা বিলুপ্ত করে তাদেরকে পরস্পর বিদ্বেষী কতগুলো দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে পরিণত করা। জাতীয়তাবাদের ধোঁয়া তুলে পশ্চিমারা এ কাজটিই করতে সক্ষম হয়েছে। দেশ, জাতি, গোত্র, অঞ্চল, ভাষা, রঙ, বর্ণ ও সংস্কৃতি- যেখানে যেটা সুবিধা মনে করেছে, সেটাকেই পুঁজি করে এক ও ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জাতিকে শতধা বিভক্ত করে দিয়েছে। সৌহার্দ্য-ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট করে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও দ্বন্ধে লিপ্ত করেছে। প্রত্যেককে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ করে বাকি সমগ্র উম্মাহ থেকে বে-খবর বরং তাদের দুশমনে পরিণত করেছে। ফলত মুসলিম জাতি পারস্পরিক সাহায্য সহানুভূতির পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। 
এই জাতীয়তাবাদ ইসলামের বিপরীতে নব-উদ্ভাবিত এক কুফরী মতবাদ। যারা এই মতবাদের প্রবর্তক, প্রচারক, ভক্ত; এর জন্য জীবন দেয়- তারা কুফরী কাজ করে বলে আমরা মনে করি।

# ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism) #
‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ কোন পক্ষে নয়। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ অর্থ- ‘কোন ধর্মের পক্ষে নয়’। অর্থাৎ, সমস্ত ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক বর্জিত। “Secularism" (সেক্যুলারিজম) এমন একটি মতবাদ, যার মূলকথা হচ্ছে- রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা প্রভৃতি ধর্মীয় শাসন থেকে মুক্ত থাকতে হবে। ধর্মনরপেক্ষতাবাদ সেই বিশ্বাসকে ধারণ করে, যাতে বলা হয়: মানুষের কর্মকাণ্ড এবং সিদ্ধান্তগুলো- বিশেষত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো- কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে না। এক কথায়, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মহীনতার সমার্থক।
ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় জীবনেও হতে পারে, ব্যক্তি-কেন্দ্রিকও হতে পারে। কোন রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার অর্থ- তার শাসনব্যবস্থা ধর্মের আওতামুক্ত। ধর্মের সাথে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের কোন সম্পর্ক নেই এবং এসবের সাথে ধর্মেরও কোন সম্পর্ক নেই। ধর্ম প্রত্যেক ব্যক্তির পারিবারিক জীবনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে আর রাষ্ট্র পরিচালিত হবে জনগণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অভিব্যক্তির ভিত্তিতে রচিত আইন-কানুন দিয়ে। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় জীবনে টেনে আনা যাবে না। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় শাসন-ব্যবস্থা কিংবা তার কোন বিধান ইসলাম ধর্মের অনুযায়ী হওয়া ধর্মনিরক্ষতাবাদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। “ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার” শ্লোগানটি দ্বারা এটিই উদ্দেশ্য। 
আর কোন ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার অর্থ- সে কোন ধর্মের অনুসারী নয়। তার জীবন ধর্মের আওতামুক্ত। সে ইসলাম ধর্মের অনুসারিও নয়, অন্য কোন ধর্মেরও নয়।
উল্লেখ্য, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অর্থ এই নয় যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, রাষ্ট্র ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী চলবে, তবে অন্যান্য ধর্মও তাতে শান্তিতে পালন করা যাবে- যেমনটা কেউ কেউ মনে করে থাকেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রবর্তক ও ধারক-বাহকসহ কোনো নির্ভরযোগ্য কর্তৃপক্ষের নিকটই ধর্মনিরপেক্ষতার এই অর্থ গ্রহণযোগ্য নয়।     
মানব জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে- রাষ্ট্রীয় জীবনে হোক, কি ব্যক্তি জীবনে- ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে আমরা কুফরী বলে মনে করি। এ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে কাফেরদের আবিস্কৃত নতুন মতবাদসমূহের একটি। দ্বীন ইসলামে এর কোন সুযোগ নেই। জীবনের সর্বক্ষেত্র: ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন- সর্বত্র অবশ্যই আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন ও শরীয়ত পরিচালকের আসনে থাকতে হবে। মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র গ্রহণযোগ্য আদর্শ ইসলামী শরীয়ত। 
উল্লেখ্য, এ বিশ্বাসের পাশাপাশি শরীয়তে কাফেরদের যতটুকু অধিকার দেয়া আছে, ততটুকু অধিকার দেয়া আমরা জরুরী মনে করি।
যারা ধর্মনিরপক্ষতাবাদের সমর্থক, প্রচারক, এর জন্য লড়াই করে তারা সবাই কুফরে আকবারে লিপ্ত বলে আমরা মনে করি। কারণ তারা আল্লাহর দ্বীনের বিপরীতে নতুন একটি মতবাদকে বেছে নিয়েছে।

# মুক্তচিন্তা #
মুক্তচিন্তার দর্শন ও মতবাদে মানুষ মাত্রই যে কোনো বিষয়ে যে কোনো চিন্তা করার এবং যে কোনো মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে; চাই তা দ্বীন-শরীয়তের বিরোধিই হোক না কেন, কুফর-শিরক-নাস্তিকতা যা-ই হোক না কেন। যেমন: যে কেউ চাইলে সমকামিতা, আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস, শরীয়ত প্রণীত কোন আইনকে অচল প্রমাণ করা ইত্যাদির অধিকার রাখে বলে মুক্তচিন্তার ধারক-বাহকরা দাবী করে থাকে। অথচ ইসলাম বলে, যে কোন ব্যক্তি যে কোন বিষয়ে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে অবশ্যই শরীয়তের নির্ধারিত সীমার ভিতরে থাকতে বাধ্য। কাজেই, মুক্তচিন্তা নামক মতবাদটি একটি ‍সুস্পষ্ট কুফরে আকবার। এ মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি অবশ্যই ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। ‍

# অসাম্প্রদায়িক চেতনা #
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন; সকল ক্ষেত্রে মুসলমান ও কাফের-মুশরেক সকলকে সমান মনে করা হয়। ধর্মের কারণে ব্যবধান অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিষিদ্ধ। তথাকথিত এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পূর্ণ ইসলামপরিপন্থী; ইসলামের ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ তথা ‘মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব আর কাফেরদের সাথে দুশমনি’ শিক্ষার বিরোধি। শরীয়ত মুসলমানদের পরস্পর ভালবাসা, সম্প্রীতি, ঐক্য ও নুসরত এবং কাফেরদের প্রতি বিদ্বেষ ও দুশমনির আদেশ দিয়েছে। মুসলমানদের উপর অমুসলিমের সব ধরনের কর্তৃত্ব নিষিদ্ধ করেছে। কোন কাফের কিছুতেই মুসলিমদের কর্তৃত্বের আসনে থাকতে পারে না। তাদের ইমাম, শাসক, আমীর বা বিচারক- কিছুই হতে পারে না। এমনকি মুসলমানদের ইমাম, শাসক, আমীর বা বিচারক নির্ধারণে কোন মতামত দেয়ারও অধিকার রাখে না। শরীয়ত বরং ইসলাম গ্রহণ না করলে, তাদেরকে জিযিয়া প্রদান করত হীনতার সাথে মুসলমানদের অধীনস্থ হয়ে বসবাসের সুযোগ দিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, উপাসনালয় ও গৃহাভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ রাখার আদেশ করেছে। এ সুযোগ গ্রহণ না করলে মুসলমানদের উপর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ফরয করেছে। 
পক্ষান্তরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাতে কাফের-মুসলিম সবাই বরাবর। ইমাম, শাসক, আমীর বা বিচারক হওয়ার অধিকার মুসলমানদের যেমন আছে, সমভাবে কাফের-মুশরেকদেরও আছে। মুসলমানদের যেমন মতামত দেয়ার অধিকার আছে, একইভাবে কাফের-মুশরেকদেরও আছে। মুসলমানদের ঈদ যেমন প্রকাশ্যে হবে, হিন্দুদের পূজাও তেমনি প্রকাশ্যে হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে কুরআন যেমন তেলাওয়াত হবে, গীতা-ত্রিপিটকও তেমনি পাঠ হবে। কোন কিছুতে ধর্মের বাধা-নিষেধ টেনে আনা, ধর্মের কারণে ব্যবধান সৃষ্টি করা অসাম্প্রদায়িক চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কাজেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা একটি ইসলামবিরোধী কুফরী চেতনা।

# মডারেট ইসলাম #
বর্তমান যুগের গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদিসহ পশ্চিমা অন্যান্য কুফরী মতাদর্শের সাথে দ্বীন ইসলামের সামঞ্জস্য বিধানের প্রচেষ্টামূলক ‘মর্ডানিস্ট’ চিন্তাধারা এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপের নামে দ্বীন ইসলামকে তরলায়িত করার চেষ্টাকে আমরা চরম গোমরাহী ও নিকৃষ্ট বিদআত বলে বিশ্বাস করি। যা অনেক ক্ষেত্রে ইলহাদ, যান্দাকাহ্ ও কুফর-শিরক পর্যন্ত গড়ায়। 
আল্লাহর মনোনীত এই দ্বীন কোন যুগের কোন মতাদর্শের আলোকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন-বিয়োজন এমনকি তরলায়িতকরণেরও সম্পূর্ণ উর্ধ্বে। অন্য সকল মতাদর্শ, চিন্তা ও রীতিনীতি দ্বীন ইসলামের সাথে সামঞ্জস্য বিধানে পরিবর্তিত হবে; কিন্তু এই লক্ষ্যে দ্বীন ইসলামকে সালাফে সালেহীনের উপলব্ধির বাইরে একচুলও পরিবর্তন করা যাবে না। দ্বীন ইসলামকে তরলায়িত করে পশ্চিমা ও অন্যান্য কুফরী মতাদর্শের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করত ‘মডারেট’ ইসলাম প্রবর্তন করার প্রচেষ্টা মূলত কাফেরদের গভীর ষড়যন্ত্র। যারা এসকল নিকৃষ্ট কাজে লিপ্ত, তারা মূলত কাফেরদের নিয়োগ দেয়া এজেন্ট কিংবা তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার। তারা সঠিকভাবে দ্বীন ইসলামকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। কাফেরদের সাময়িক চাকচিক্য দেখে এই দ্বীনের ব্যাপারে হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হয়েছেন।


# তাকফীর #
তাকফীরের ক্ষেত্রে আমরা চরমপন্থা (إفراط) ও শিথীলতা (تفريط) উভয়টিকে পরিত্যাগ করে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করি।
আমরা খারেজীদের মাযহাবকে প্রত্যাখ্যান করি, যারা কবিরা গুনাহের কারণে মুসলিমদেরকে তাকফীর করে। কোন মুসলমানকে আমরা কবিরা গুনাহের কারণে তাকফীর করি না, যতক্ষণ না সে গুনাহটিকে হালাল সাব্যস্ত করে অথবা তার থেকে ঈমান ভঙ্গের অন্য কোন কারণ প্রকাশ পায়।
আমরা মুরজিয়াদের মাযহাবকেও অস্বীকার করি যারা বলে, ‘অন্তরে ঈমান থাকলে কথা ও কাজের কারণে মানুষ কখনই কাফের হয় না।’ উল্লেখ্য, বর্তমান আহলে সুন্নত দাবিদারদের অনেকে মুরজিয়াদের মতো আকীদা পোষণ করে থাকে যে- ‘অন্তরে ঈমান থাকলে কথা ও কাজের কারণে মানুষ কখনই কাফের হয় না।’ আমরা তাদের মাযহাব প্রত্যাখ্যান করি। 
আমরা বলি, আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মতে এমন কিছু কথা ও কাজ আছে, তা যদি কোন মুসলিম বলে বা করে, তাহলে সে কথা ও কাজ তাকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়- যদিও তার অন্তরে পরিপূর্ণ ঈমান বিদ্যমান থাকে। যেমন: রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিয়ে কটূক্তি, শরীয়তের কোন বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ ইত্যাদি। 
তাহকীক ও সুনিশ্চিত প্রমাণ ছাড়াই তাড়াহুড়া করে কাউকে তাকফীর করা বা তাকফীরের বিধান প্রয়োগ করা (যেমন- মুরতাদস্বরূপ কতল করা) আমাদের মানহাজে নেই। কারণ, তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন মুসলমানকে হত্যা করা অতীব গুরুতর একটি বিষয়। ভুলক্রমে একজন নিরপরাধ মুসলমানের রক্তপাত করা অপেক্ষা ভুলক্রমে হাজারো কাফেরকে ছেড়ে দেয়া ক্ষুদ্রতর। একই সঙ্গে আমরা বিশ্বাস করি, সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীত কোন কুফরে লিপ্ত ব্যক্তিকে তাকফীর করা জরুরি। সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ ছাড়াই কোন মুসলমানকে তাকফীর করা যেমন গুরুতর, সুস্পষ্ট মুরতাদকে মুরতাদ ঘোষণা না করা এবং তার সাথে মুসলমানদের মতো আচরণ করাও তেমনি ক্ষতিকর। কেননা, এতে ঈমান কুফরের সীমারেখা বিঘ্নিত হওয়ার এবং অন্যান্য মুসলমান উক্ত কুফরকে কুফর মনে না করার এবং তাতে লিপ্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। 
আমরা বিশ্বাস করি (تكفير معيّن) তথা নির্দিষ্টভাবে কারো উপর কুফরের হুকুম প্রদানের পূর্বে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে, যেগুলো উক্ত ব্যক্তির মাঝে পরিপূর্ণ পাওয়া যেতে হবে এবং কিছু  (موانع) তথা প্রতিবন্ধক রয়েছে, যেগুলো না পাওয়া যেতে হবে। হক্কানী বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামই নির্দিষ্টভাবে কোন ব্যক্তির উপর কুফরের হুকুম প্রদানের যোগ্যতা রাখেন। সাধারণ মানুষের জন্য তাদের অনুসরণ করা জরুরি।
যেমন- শরীয়ত বিরোধি আইন প্রণয়ন কিংবা সে অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা কুফরে আকবার, যা উক্ত ব্যক্তিকে দ্বীনে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এসব ব্যক্তিকে ভোট দেয়াও মূলত তাদের কুফরী কর্মে অংশগ্রহণ করা। কিন্তু এ কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকলকে আমরা ঢালাওভাবে কাফের ঘোষণা করি না- যেমনটা নব্য খাওয়ারেজদের অনেকে করে থাকে। কারণ অধিকাংশ ভোটদাতাই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণের হুকুম সম্পর্কে অজ্ঞ। এজন্য সংসদীয় নির্বাচনে ভোট দেয়া কুফরী কাজ হওয়া সত্ত্বেও আমরা সাধারণভাবে ভোটদাতা সকলকে তাকফীর করি না। 
একইভাবে, যেসব জামাত ইসলামের নামে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাদেরকেও আমরা তাদের ‘তাবিলের’ কারণে তাকফীর করি না- যদিও তাদের এই কাজকে আমরা হারাম ও কুফরী মনে করি।
এছাড়া অন্যান্য সেবাধর্মী সংস্থার নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা এ উদ্দেশ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না যে, নির্বাচিতরা আল্লাহ তাআলার শরীয়ত বিরোধি আইন-কানুন প্রণয়ন করবে; বরং এই ক্ষেত্রে তারা দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন দুনিয়াবী সেবা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে লক্ষ্য করে ভোট দিয়ে থাকে। যেমনঃ সিটি কর্পোরেশন কিংবা মিউনিসিপালটি নির্বাচন। তাই এই ধরনের নির্বাচনকে আমরা কুফর বলে মনে করি না। 

আমরা “যে ব্যক্তি কাফেরকে কাফের মনে করে না, সে নিজেই কাফের” কথাটাকে শুধুমাত্র তাকফিরুন নসের ক্ষেত্রে (অর্থাৎ যেসব ব্যক্তি বা জাতি-গোষ্ঠীকে কোরআন সুন্নাহ সুস্পষ্ট কাফের আখ্যায়িত করেছে- তাদের ক্ষেত্রে) প্রযোজ্য মনে করি। এই কথাকে খারেজীদের মতো তাকফিরুল ইজতিহাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করি না। যেমন- বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীকে আমরা মুরতাদ মনে করলেও কোন মুসলমান ইলমের স্বল্পতার কারণে কিংবা ভুল ব্যাখ্যার কারণে এদেশের শাসকগোষ্ঠীকে মুরতাদ মনে না করলে, আমরা সেই ব্যক্তিকে কাফের মনে করি না- যেমনটা নব্য খাওয়ারেজরা করে থাকে।



# বর্তমান যুগের খারেজীদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান #
আমরা নব্য খাওয়ারেজ আইএস থেকে নিজেদেরকে মুক্ত ঘোষণা করি। আমরা তাদের ঘোষিত খিলাফতের স্বীকৃতি দিই না এবং তাদের এই খিলাফতকে বৈধ খিলাফত মনে করি না।
তবে তাদের তাকফীরি নীতির কারণে আমরা তাদেরকে কাফের মনে করি না; যতক্ষণ না তাদের মাঝে ঈমান ভঙ্গের অন্য কোনো কারণ পাওয়া যাবে। 
পশ্চিমা কুফফার, নুসাইরি বাশার আল-আসাদ, ইরান, রাশিয়া ও অন্যান্য কাফের-মুরতাদদের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণকে আমরা সমর্থন করি, যতক্ষণ তাতে শরীয়ত বহির্ভূত কিছু না পাওয়া যায়। 
আমরা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে কাফের-মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ করাকে প্রাধান্য দিই। তবে তারা আমাদের উপর কিংবা অন্যান্য মুসলমানের উপর আক্রমণ করলে, তাদের আক্রমণ প্রতিহত করা এবং মুসলিম উম্মাহর খুন ঝরানো থেকে তাদেরকে নিবৃত করা জরুরী মনে করি। এমতাবস্থায় হাত গুটিয়ে বসে থাকাকে আমরা সমীচিন মনে করি না।



# শাসক #
মুসলমানদের শরীয়তসম্মত ইমাম ও শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা আমরা জায়েয মনে করি না; যতক্ষণ না তাদের থেকে ‘কুফরে বাওয়াহ’ তথা সুস্পষ্ট কুফর প্রকাশিত হয়, যে কুফর সম্পর্কে আমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। শরীয়তসম্মত ইমাম ও শাসকেরা যতক্ষণ সৎ কাজের আদেশ দেন, ততক্ষণ তাদের অনুগত থাকা ফরজ মনে করি; কিন্তু অসৎ কাজে তাদের আনুগত্য জায়েয মনে করি না।
একই সাথে আমরা বিশ্বাস করি, কোন মুসলিম শাসক মুরতাদ হয়ে গেলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হয়ে যায়। এরপরও যদি জবরদস্তি ক্ষমতায় বসে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাকে অপসারণ করে শরীয়ত প্রতিষ্ঠাকারী ন্যায়পরায়ণ মুসলিম শাসক নিয়োগ দেয়া ফরয। এ ব্যাপারে আইম্মায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে।   
আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ও এ রকম অন্যান্য দেশের যে সকল শাসক শরীয়াহ্ পরিপন্থী আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তারা কাফের ও মুরতাদ। কারণ, তারা-
আল্লাহ তাআলার ‘তাওহীদুর-রুবূবিয়্যাহ্’ প্রত্যাখ্যান করে নিজেদেরকে রবের আসনে সমাসীন করেছে। বিধান দানের যে অধিকার আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ব্যতীত আর কারও নেই, তারা তা নিজেদের জন্য দাবি করেছে। 
শরীয়তের পরিবর্তে মানব রচিত কুফরী আইন প্রণয়ন ও প্রবর্তন করেছে এবং জনসাধারণের উপর তা চাপিয়ে দিয়েছে। 
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বাদ দিয়ে বিশ্বের তাগুত ও আইম্মায়ে কুফরদের কাছে বিচার প্রার্থনা করে। 
ঈমান ও কুফরের চলমান যুদ্ধে কুফরের পক্ষ অবলম্বন করে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে সহায়তা করছে।  
যারা কুফরভিত্তিক সরকার ব্যবস্থার অধীনে কাজ করে, ঢালাওভাবে আমরা তাদেরকে তাকফীর করি না- যা কিনা চরমপন্থী ‘মুকাফফিরাহ্’ শ্রেণী করে থাকে। আমরা শুধুমাত্র তাদেরকেই তাকফীর করি, যাদের কর্মকাণ্ড কুফরে আকবারের মধ্যে পড়ে। যারা কুফরী শাসন ও কুফরী বিধি-বিধান প্রণয়ন, প্রবর্তন বা বাস্তবায়নে লিপ্ত কিংবা যাদের মধ্যে অন্য কোন সুস্পষ্ট কুফর পাওয়া যায়; আমরা কেবল তাদেরকেই তাকফীর করি। পক্ষান্তরে যাদের কর্মকাণ্ড এই শ্রেণীভুক্ত নয়, অন্য কোন কুফর না পাওয়া গেলে আমরা তাদের তাকফীর করি না। যেমন- মুরতাদ সরকারের বিদ্যুৎ, পানি বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইত্যাদীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আমরা তাকফীর করি না।
মুরতাদ সরকারের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নৌবাহিনীসহ অন্য সকল সশস্ত্র বাহিনী এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদেরকে আমরা (طائفة مرتدة ممتنعة) হিসেবে দেখি। অর্থাৎ তারা এমন বাহিনী, যাদের প্রতিটি সদস্য কুফরী কর্মে লিপ্ত; কিন্তু তারা তাদের শক্তিবলে তাদের ব্যাপারে আল্লাহর শরীয়তে যে বিধান বর্ণিত হয়েছে (যেমন- তাকফীরের প্রতিবন্ধক শরীয়তসম্মত কোন ওজর না পাওয়া গেলে মুরতাদ হিসেবে হত্যা করা), তা তাদের উপর কায়েম করতে দিচ্ছে না। মুসলিমদের জন্য তাদেরকে পাকড়াও করে যাচাই বাছাই করত তাদের উপর আল্লাহর শরীয়তের বিধান কায়েম করা সম্ভব হচ্ছে না। এই বাহিনীর সদস্যদের বিধান মুরতাদদের বিধানের অনুরূপ। তাদের বিরুদ্ধে মুরতাদদের মতই কিতাল করা হবে। তবে তাদের অনেকের মাঝেই অজ্ঞতা (الجهل), তাবীল (التأويل) ইত্যাদির মতموانع التكفير তথা তাকফীরের প্রতিবন্ধক বিষয় বিদ্যমান থাকার প্রবল সম্ভাবনার কারণে, সুনির্দিষ্টভাবে তাদের প্রতিটি সদস্যকে আমরা তাকফীর করি না। 
একইভাবে এসব বাহিনীর পরিবারের সদস্যদের আমরা তাকফীর করি না- যদি না তাদের থেকে সুস্পষ্ট কোন কুফর প্রকাশ পায়। তাদের রক্ত প্রবাহ করা কিংবা তাদের মাল গনীমত বানানো আমরা বৈধ মনে করি না।
# গণতান্ত্রিক ‘ইসলামী’(?) দলসমূহ #
গণতন্ত্র ও ইসলামের সমন্বয় কখনই সম্ভবপর নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম কায়েমের প্রচেষ্টা অবাস্তব, অসম্ভব।
কোন কোন আলেমের ভুল ইজতেহাদ ও অগ্রহণযোগ্য ফতোয়ার কারণে অনেকে ইসলামের নামে নাপাক গণতন্ত্রের খপ্পরে পড়েছে। এ সমস্ত ‘ইসলামী গণতান্ত্রিকদেরকে’ তাদের তাবিলের (নুসুসের ভুল ব্যাখ্যা বুঝা, ভুল প্রয়োগ করা বা বাস্তবতার ব্যাপারে অজ্ঞতা- যা তাকফীরের প্রতিবন্ধক) কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কুফরীতে জড়িত হবার পরও আমরা তাদেরকে তাকফীর করি না। কিন্তু আমরা তাদেরকে ভুল পথের পথিক মনে করি এবং তাদের কাজকে হারাম মনে করি। গণতন্ত্রের ধোঁকা ও প্রতারণা তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করি। সঠিক পথে ফিরিয়ে এনে তাদের বিপ্লবী চেতনাকে ইসলামী পন্থা ও জিহাদের পথে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।




# শরীয়াহ্ প্রতিষ্ঠা #
আমরা বিশ্বাস করি, সমগ্র বিশ্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে শরীয়াহ্ প্রতিষ্ঠা করা মুসলিমদের উপর ফরয; বিশেষভাবে ঐসব ভূমিতে, যেখানে পূর্বে ইসলামের কর্তৃত্ব ছিল এবং ইসলামী শরীয়াহ্ প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে কাফের মুরতাদদের দখলে চলে যায়।
আমরা ঐসব মুসলিম দেশগুলোর জনসাধারণকে তাকফির করি না, যেসব দেশে শরয়ী আইন প্রয়োগ হয় না; যেমনটি চরমপন্থী মুকাফফিরাহ শ্রেণীর খারিজীরা করে থাকে। বরং আমরা মনে করি, মুসলিম জনসাধারণ আমাদের মুমিন ভাই। তাদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু’র কোন ধরনের ক্ষতি করা আমরা হারাম মনে করি, যদিও তারা গুনাহগার হয়। তাদের পরিপূর্ণ হক্ব আদায়ের আমরা বদ্ধপরিকর।
মুসলিম জনসাধারণকে যে কোন প্রকার জুলম থেকে রক্ষা করা আমরা আমাদের দায়িত্ব মনে করি এবং মুজাহিদদেরকে এই জিম্মাদারী সাধ্যমত পূর্ণ করার তাগিদ দিই।
মুসলিম জনসাধারণের সাথে আমাদের সম্পর্ক শত্রুতা বা বিদ্বেষের নয় বরং ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের। ইসলাহী দাওয়াত এবং আমর বিল মা’রুফ ও নাহি আনিল মুনকারের মাধ্যমে তাদের দ্বীনের পথে আগ্রহী করতে আমরা চেষ্টা করি। তাদের মাঝে বিদ্যমান শরীয়ত বিরোধী বিষয়গুলো সংশোধন করত তাদেরকে পূর্ণ দ্বীনের উপর উঠাতে এবং তাদেরকে জিহাদী কাফেলার সাথে যুক্ত করতে আমরা সর্বদা সচেষ্ট থাকি।



# জিহাদ ফী-সাবিলিল্লাহ #
মুরতাদ শাসকদেরকে হটিয়ে আল্লাহ তা’আলার জমিনে তাঁর শরীয়াহ্ প্রতিষ্ঠা এবং আগ্রাসী কাফের কর্তৃক দখলকৃত মুসলিম ভূমিসমূহ পুনরুদ্ধারের জন্য জিহাদ ফী-সাবিলিল্লাহকে বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রতিটি সক্ষম মুসলিমের উপর আমরা ফরযে আইন মনে করি। কেননা এ দু’টি কারণে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ফরজে আইন হয়ে যায় বলে ইজমা রয়েছে। এ কারণে নামাজ রোযা যেমন ফরযে আইন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে জিহাদকেও একই রকম ফরযে আইন গণ্য করি।
জিহাদ বলতে আমরা বুঝি- ‘ই’লাউ কালিমাতিল্লাহ্’ তথা যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কিতাল বা যুদ্ধের জন্য জান-মাল কুরবান করা। আর এ কিতাল বাস্তবায়নের জন্য জিহাদ-সংশ্লিষ্ট ও জিহাদের মওকূফ আলাইহি পর্যায়ের সকল কাজই জিহাদের অংশ। যেমন: অস্ত্র ও মাল সংগ্রহ, সৈনিক সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রদান এবং মিডিয়ার কাজ ইত্যাদি।
যারা গ্রহণযোগ্য শরয়ী ওজর ব্যতীত জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহতে শরীক হচ্ছে না বা এর জন্য যথাযোগ্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে না, তারা ফরজ তরকের কারণে গুনাহগার হচ্ছে বলে আমরা মনে করি; যদিও তারা দ্বীনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে থাকে।
যারা বর্তমান যুগে জিহাদকে শুধু এর শাব্দিক অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে চায়, কিংবা কলমের জিহাদ, পিতা-মাতার খেদমত কিংবা মাদ্রাসায় দরস দেয়ার মাধ্যমে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’র ফরজিয়াত আদায় হয়ে যাবে বলে দাবী করে, তাদের এসব দাবীকে আমরা নব-উদ্ভাবিত বিদআত মনে করি। 
আমরা বিশ্বাস করি, কোন ইনসাফকারীর ইনসাফ অথবা কোন জালিমের জুলুম এই জিহাদকে বন্ধ করতে পারবে না। কেয়ামত পর্যন্ত সর্বদাই একটি হক্ব জামাত হক্বের উপর জিহাদ চালিয়ে যাবে। 
একইভাবে খলিফা, রাজা কিংবা শাসকের অনুমতি ছাড়া জিহাদ করা যাবে না বলে যারা দাবী করে, তাদের এই দাবীকেও আমরা ভ্রান্ত ও বিদআত মনে করি, শরীয়তে যার কোন প্রমাণ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরামসহ সালাফে সালেহীনের কেউ জিহাদের ব্যাপারে এ রকম কোন শর্ত আরোপ করেননি। এটা, আল্লাহর বিধানে নেই, এমন বিষয়কে শর্ত হিসাবে জুড়ে দিয়ে আল্লাহর বিধানকে অকার্যকর করার নামান্তর। 
একইভাবে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’র জন্য মুজাহিদগণের নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র থাকতে হবে বলে যারা দাবী করে, তাদের এই দাবীও আমরা ভ্রান্ত ও বিদআত মনে করি, যার কোন প্রমাণ শরীয়তে নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরামসহ সালাফে সালেহীনের কেউ জিহাদের ব্যাপারে এ রকম কোন শর্ত আরোপ করেননি। এটিও, আল্লাহর বিধানে নেই, এমন বিষয়কে শর্ত হিসাবে জুড়ে দিয়ে আল্লাহর বিধানকে অকার্যকর করার নামান্তর। 
একইভাবে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’র জন্য মুজাহিদদের সংখ্যা শত্রুর অর্ধেক হওয়াকে যারা জিহাদের নতুন শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়, তা-ও আমরা ভ্রান্ত ও বাতিল মনে করি।



# ফিকহের ক্ষেত্রে আমাদের মূলনীতি #
ফিকহের ক্ষেত্রে আমাদের মূলনীতি হল, যার যার মাজহাব-মাসলাকে থেকে আঞ্চলিক হক্কানী ও নির্ভনরযোগ্য উলামায়ে কেরামের অনুসরণ। 
আমাদের কাছে শরয়ী দলীল হল কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কুরআন-সুন্নাহ থেকে আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীনের নির্ভরযোগ্য কিয়াস। 
সম্মানিত চার ইমাম– ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমাদ (রহিমাহুমুল্লাহ) এবং অন্য সকল মুজতাহিদ ইমামকে আমরা যথাযোগ্য সম্মান করি এবং তাদেরকে ভালোবাসি। তাঁদেরকে নিজেদের সালাফ মনে করি এবং তাঁদের পথ অনুসরণ করি।
মুজতাহিদ ইমামগণ কোন ইজতিহাদি মাসআলায় যদি ভুল করে থাকেন, তবুও তিনি তাঁর ইজতিহাদের প্রতিদান পাবেন। তবে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে কুরআন সুন্নাহ’র আলোকে তাঁদের কোন ইজতিহাদ ভুল প্রমাণিত হলে, আমরা তা অনুসরণ করি না। এক্ষেত্রে তাঁদের যথাযোগ্য সম্মান বজায় রেখে কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত বিষয়টি অনুসরণ করি এবং কুরআন সুন্নাহ উপেক্ষা করে অন্ধভাবে মুজতাহিদের এমন ভুল আঁকড়ে রাখাকে বিভ্রান্তি মনে করি।  
ইজতিহাদি ভুলের কারণে যারা সম্মানিত ইমামদের সমালোচনা করে, অভিযুক্ত করে, বিরূপ মন্তব্য করে তাদের সাথে আমাদের তানজিমী কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তাদের এ কাজকে অপছন্দ করি।
যথাযথ যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও মুজতাহিদগণের অনুসরণ না করে যারা নিজেরাই ইজতিহাদ করে আমলের কথা বলে, আমরা তাদেরকে ভুল পথের পথিক মনে করি।
একইভাবে, ইমামদের অনুসরণের ক্ষেত্রে যারা অন্য ইমামগনের মতকে অসম্মান করে এবং অন্য কোন মুজতাহিদ ইমামের মতামত গ্রহণ করার কারণে অন্যদের ভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করে, আমরা তাদের এ কাজও অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি মনে করি।
ইজতেহাদী মাসআলার ক্ষেত্রে আমরা কোন মুসলমানকে গুনাহগার ভাবি না এবং তার সাথে সম্পর্কও ছিন্ন করি না।